
বলিউডের কিং খানকে কে না চেনেন। শুধু বলিউড নয়, বিশ্বের অন্যতম ধনী তারকা শাহরুখ খান। তবে শাহরুখ খান ধনী হয়েছেন কষ্ট করে। জনপ্রিয়তা আর মানুষের ভালোবাসায়।
শাহরুখ খানের মতো বাংলাদেশেও আছেন একজন কিং খান। তিনিও তারকা, তবে শোবিজের নন। বাংলাদেশে দুর্নীতির ‘কিং খান’ নিঃসন্দেহে শাজাহান খান। দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসই যার অর্থ উপার্জনের প্রধান হাতিয়ার।
বৈধ কোনো আয় ছাড়াই তিনি বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। চাঁদাবাজি এবং দখল বাণিজ্যের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের ভিতর সমালোচিত এবং বিতর্কিত। কিন্তু তার ছিল নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। যে কারণে দলের ভিতরও তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না।
লুটপাটের মাধ্যমে শাজাহান খান হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত শাজাহান খান একসময় জাসদের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। টানা আটবারের এই সংসদ সদস্য (এমপি) নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরিবহন সেক্টর এবং বিআইডব্লিউটিএতে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনী।
তাদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন অতিষ্ঠ। ভাই ও স্বজনদের মাধ্যমে মাদারীপুর জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তার একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি- সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। নৌপরিবহনমন্ত্রী থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। নিজস্ব বলয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন। শাজাহান খান মাদারীপুর-২ (সদর-রাজৈর) আসনের সাবেক এমপি। মাদারীপুরে তার বিকল্প কেউ নেই বলে মনে করত তার পরিবার। খান পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে সদর ও রাজৈরে কোনো কাজ হতো না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়িও মাদারীপুর শহরে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরোটা এই দুই কেন্দ্রীয় নেতার দ্বন্দ্ব জাতীয়ভাবেও আলোচিত। পরিবহন শ্রমিকনেতা হিসেবে বিগত আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে এ খাতের চাঁদার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন শাজাহান খান। তাদের দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অতিষ্ঠ। বিআইডব্লিউটিএ ঘিরে এখনো চলছে শাজাহান খান বাহিনীর তান্ডব। অনেক কর্মকর্তাকে তারা জিম্মি করে নিজের অস্তিত্বের বিষয়ে জানান দিচ্ছেন।
শাজাহান খান ২০১৩ সালে গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। এ সময় তার বিরুদ্ধে অমুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মিলে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ। একাংশের চাঁদা ওঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক লীগ নেতা আখতার, সারোয়ার, আবুল, মজিবুর, রফিক গংদের।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, ১৫ বছরে শাজাহান খানের আয় বেড়েছে ৩২ গুণ। শাজাহান খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, সার্বিক পেট্রোল পাম্প সবকিছুই তার স্বজনদের নামে। মাদারীপুর-ঢাকা ও ঢাকা-বরিশাল সড়কপথে আধিপত্য বিস্তারকারী সার্বিক পরিবহন তার মালিকানাধীন। সার্বিক পরিবহনের নামে বর্তমানে দুই শতাধিক গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ছেলে আসিবুর রহমান খান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান শাজাহান খান ও তার পরিবারের সদস্যরা। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তার ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মন্ত্রী থাকতে বাবা আচমত আলী খানের নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন শাজাহান খান। সংগঠনটির কোনো স্থায়ী ও অস্থায়ী কার্যালয় নেই। প্রতি বছর বড় পরিসরে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে সরকারের মন্ত্রী ও শিল্পপতিদের রাখা হতো। সংগঠন সূত্র জানায়, নৌমন্ত্রী থাকতে শাজাহান খান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বছরে একবার ঠোঁটকাটা-তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়া কোনো সেবামূলক কাজই হয়নি।
শাজাহান খান নৌমন্ত্রী থাকাকালে মাদারীপুরের প্রায় ৩ হাজার কর্মীকে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসিসহ বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিয়েছেন বলে তিনি নিজেই বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিটি চাকরির জন্য শাজাহান খান ও তার ভাইয়েরা ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যে মূল তদারকি করতেন শাজাহান খানের তৎকালীন বিশেষ সহকারী রণজিৎ বণিক।
২০০৯ সাল থেকে পরিবহন খাতে প্রকাশ্যে যানবাহনপ্রতি ৭০ টাকা চাঁদা আদায় শুরু করা হয়। এর মধ্যে ৪০ টাকা যায় মালিক সমিতির হাতে। আর শ্রমিক ইউনিয়নের ১০ টাকা এবং ফেডারেশনের ১০ টাকা। বাকি ১০ টাকা সড়ক শৃঙ্খলায় নেওয়া হতো। এর বাইরে অপ্রকাশ্য চাঁদা উঠত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে এ খাতে বছরে চাঁদার পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় শাজাহান খানের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজির টাকায় মাদারীপুরে এবং ঢাকায় গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে তার আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। একই সময়ে তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচ গুণ। হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের দুটি গাড়ি এবং স্ত্রীর নামে ৮০ ভরি সোনা ছাড়া আর কোনো অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়নি। ২০০৮ সালে দুটি বাস, একটি গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস, ১৫ ভরি সোনাসহ প্রায় ৪১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছিল। শাজাহান খান ও তার স্ত্রীর বেশ কিছু কৃষি ও অকৃষিজমি আছে। প্রায় ৬ কোটি টাকার ভবন ও সমজাতীয় স্থাপনা আছে। দান সূত্রেও ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। তার স্ত্রীর নামে আছে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পদ। তবে তার দুই ছেলে ও মেয়ের নামে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হাফিজুর রহমান খানের জমি, সরকারি অর্পিত সম্পত্তি ইজারা নিয়ে করা ১৬টি দোকান ও পাটকল আছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১ একর জমিতে অস্থায়ী দোকান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে দুটি বহুতল ভবন, একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, দুটি বাণিজ্যিক ভবন, একটি বিলাসবহুল পাঁচতলা আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে। একই এলাকায় শাজাহান খানের ১০ তলা ভবন আছে। শাজাহানের আরেক ভাই ওবায়দুর রহমানের দুটি বহুতল বাড়ি আছে। থানার সামনে শাজাহানের ছোট ছেলে শামস খানের পাঁচতলা নতুন ভবন, পাশেই হাফিজুর রহমান ও খান পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন হাসপাতাল, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরান বাজারে জমি আছে। পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড চৌরাস্তা ও কুলপদ্বী এলাকায় জমি ও বাড়ি আছে। সরকার পতনের দিন বিকালে শাজাহান খানের বিলাসবহুল ১০ তলা বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। তখন হাফিজুর ও ওবায়দুর রহমান খানের মালিকানাধীন চারটি ভবন, দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর আগেই শাজাহান খান ও তার ভাইয়েরা আত্মগোপনে চলে যান। সম্প্রতি তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিলাসবহুল বাড়িগুলো নতুন করে মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকরা।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।