শেষ ইচ্ছে পূরণ হলো না মনু মিয়ার, পাড়ি দিলেন ‘শেষ ঠিকানায়’

‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ মনু মিয়া। পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তিনি সাজাতেন মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ ঠিকানা-কবর। কারও মৃত্যু সংবাদ কানে আসা মাত্রই ঘোড়ার পিঠে চড়ে খুন্তি-কোদাল হাতে দূর দূরান্তে ছুটতেন মনু মিয়া। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার ঘোড়াটিকে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

এতে ৬৭ বছরের প্রবীণ এই গোরখোদক মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েন। শনিবার (২৮ জুন) সকাল ১০টায় সেই শোক নিয়েই নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মনু মিয়া (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বাহাউদ্দিন ঠাকুর তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া। প্রায় ৪৯ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি কবর খুঁড়েছেন তিন হাজারেরও বেশি মানুষের। একটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে তিনি ছুটে যেতেন মৃতের বাড়িতে, এই কাজের জন্যই তিনি একসময় দোকান বিক্রি করে কিনেছিলেন প্রিয় ঘোড়াটি।

মনু মিয়ার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জীবনের প্রায় অর্ধশত বছর তিনি ব্যয় করেছেন কবর খননের মহান কাজে, বিনিময়ে কখনো কিছু চাননি। আশপাশের গ্রাম ও জেলাজুড়েও পরিচিত ছিলেন ‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ নামে।

ঢাকার আইনজীবী এবং এলাকার সন্তান অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ রোকন রেজা গণমাধ্যমকে জানান, কিছুদিন আগে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মনু মিয়া। সেই সময় দুর্বৃত্তরা তার বহু বছরের সঙ্গী প্রিয় ঘোড়াটিকে হত্যা করে। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।

ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন ঠাকুর বলেন, ঘোড়ার মৃত্যুর পর থেকেই মনু মিয়া শারীরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে এলেও আর আগের মতো হয়ে ওঠেননি। তার মৃত্যুতে আমরা একজন দয়ার সাগর, নিঃস্বার্থ মানুষকে হারালাম। এমন মানুষের অভাব কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

মনু মিয়ার শেষ ইচ্ছে ছিল হজে যাওয়া

ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া ১৮ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন কবর খোঁড়া। দীর্ঘ প্রায় ৪৯ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কবর খননের কাজ করে আসছেন। তার হাতে খুঁড়ে যাওয়া তিন হাজারের বেশি কবর এখনো সাক্ষী মানবিকতার এক অনন্য অধ্যায়ের।

দীর্ঘ দিন ধরে কবর খুঁড়ে আসলেও কারো কাছ থেকে কোনো রকম টাকা-পয়সা কিংবা বকশিশ নেননি তিনি।

এমনকি ঘোড়াটিকে হত্যার পর অনেকেই তাকে ঘোড়া কিনে দিতে চাইলে তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি। তবে তার শেষ ইচ্ছা ছিল নিজ টাকায় হজে যাওয়ার। সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি মনু মিয়ার।

জীবদ্দশার শেষ দিকে মনু মিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন নিজ টাকায় হজে যাওয়ার আগ্রহের বিষয়টি। সে সময় তিনি বলেছিলেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবো। তোমরা সবাই দোয়া করো। আমার কোনো টাকা-পয়সা চাই না, আমি শুধু দোয়া চাই। আমার একটাই ইচ্ছে সুস্থ হয়ে হজে যাবো, তবে নিজের টাকায় যাবো। অনেক মানুষ বলেছেন হজে পাঠাবে, আমি রাজি হয়নি। ভালো কাজ করেছি, তাই অনেক মানুষ হাসপাতালে আমাকে দেখতে আসতেছে।

প্রসঙ্গত শুক্রবার ১৬ মে এই ঘোড়াটিকে মিঠামইন উপজেলা কাঠখাল ইউনিয়নের হাসিমপুর গ্রামে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ওই সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন মনু মিয়া। এরপর প্রিয় ঘোড়ার মৃত্যুর খবরটি মনু মিয়ার কাছে গোপন করে পরিবার। বিষয়টি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র নিন্দা ঝড় ওঠে, আলোচনায় আসেন মনু মিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *