
বিশ্বের নজর কেড়েছে চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ, যেখানে প্রদর্শিত হয়েছে অত্যাধুনিক এবং আগে কখনো দেখা না যাওয়া সমরাস্ত্র। আমেরিকান বিমানবাহী রণতরী বিধ্বংসী মিসাইল, আন্ডারওয়াটার ড্রোন,
মানববিহীন হেলিকপ্টার, এবং আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলসহ অকল্পনীয় অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শনের মাধ্যমে চীন তার সামরিক শক্তির বহুদূর অগ্রগতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। এই কুচকাওয়াজে স্পষ্ট হয়েছে যে, চীন সামরিক প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কুচকাওয়াজে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছে ডিএফ-৫সি নামের নতুন আন্তমহাদেশীয় কৌশলগত পারমাণবিক মিসাইল। এই মিসাইলের পাল্লা ২০,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি, যা বিশ্বের যেকোনো দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম। তরল জ্বালানিচালিত এই মিসাইল নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে এবং একাধিক পারমাণবিক বা প্রচলিত ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। এর অর্থ, এই মিসাইল বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে চীনের কৌশলগত শক্তি প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
এছাড়া, কুচকাওয়াজে প্রথমবারের মতো দুটি আন্ডারওয়াটার ড্রোন প্রদর্শিত হয়েছে। প্রথমটি হলো এজেএক্স০০২, যার দৈর্ঘ্য ১৮ থেকে ২০ মিটার এবং ব্যাস ১ থেকে ১.৫ মিটার। দ্বিতীয় ড্রোনটিও ১৮ থেকে ২০ মিটার লম্বা, তবে এর কাঠামো উল্লেখযোগ্যভাবে চওড়া, যার ব্যাস ২ থেকে ৩ মিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ড্রোনগুলোর নির্দিষ্ট কাজ এখনো অজানা। এগুলো টর্পেডো বা মাইন বহন করতে পারে অথবা নৌ-অভিযানে পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। চীনের এই ড্রোন প্রযুক্তি বিশ্বের বৃহত্তম এক্সট্রা-লার্জ আনম্যানড আন্ডারওয়াটার ভেহিকল (XLUUV) প্রোগ্রামের অংশ, যেখানে ইতোমধ্যে পাঁচটি ভিন্ন ধরনের ড্রোন পানিতে সক্রিয় রয়েছে।
চীন এই কুচকাওয়াজে প্রথমবারের মতো চার ধরনের ওয়াইজে সিরিজের জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল প্রকাশ করেছে: ওয়াইজে-১৫, ওয়াইজে-১৭, ওয়াইজে-১৯, এবং ওয়াইজে-২০। এর মধ্যে ওয়াইজে-১৫ ছাড়া বাকি তিনটি হলো হাইপারসোনিক মিসাইল, যারা ম্যাক ৫-এর বেশি গতিতে চলতে সক্ষম। এই মিসাইলগুলো বিমান, যুদ্ধজাহাজ, এবং সাবমেরিনের মতো একাধিক প্ল্যাটফর্ম থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। এদের দীর্ঘ পাল্লা, দ্রুত গতি, এবং উচ্চ বিধ্বংসী ক্ষমতা এগুলোকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথম সারির অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই মিসাইলগুলো বিশেষভাবে আমেরিকান বিমানবাহী রণতরী এবং ডেস্ট্রয়ারের মতো বড় নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা তাইওয়ান প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।
কুচকাওয়াজে চীন ছয় ধরনের বিমান প্রতিরক্ষা এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল বিরোধী সরঞ্জাম প্রদর্শন করেছে: এসকিউ-১১, এসকিউ-২০, এসকিউ-২২, এসকিউ-৯সি, এসকিউ-৯এ, এবং এসকিউ-৯। এর মধ্যে এসকিউ-৯ প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে এসেছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো দীর্ঘ, মাঝারি, এবং স্বল্প পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা মিশন পরিচালনা করতে পারে এবং বহুমুখী ও বহুস্তরের ব্যালিস্টিক মিসাইল ঠেকাতে পারদর্শী। চীন বিশ্বের স্বল্পসংখ্যক দেশের মধ্যে একটি, যারা একটি সম্পূর্ণ ব্যালিস্টিক মিসাইল বিরোধী ব্যবস্থার অধিকারী, যা এই কুচকাওয়াজে স্পষ্ট হয়েছে।
এছাড়া, এই কুচকাওয়াজে প্রথমবারের মতো বেশ কয়েকটি নতুন আকাশযান জনসম্মুখে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র নজরদারি ড্রোন, উইংম্যান ড্রোন, এবং জাহাজবাহিত মানববিহীন হেলিকপ্টার। এই আকাশযানগুলো স্টেলথ হামলা চালাতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধে নতুন কৌশল নিয়ে আসবে। বিশেষ করে উইংম্যান ড্রোন ভবিষ্যতের মানববিহীন যুদ্ধের জন্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি সেন্সর এবং গোলাবারুদের ডিপো হিসেবে কাজ করে এবং মানব পাইলটদের সহকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এটি বিপদগ্রস্ত পাইলটদের সহায়তা করে এবং যুদ্ধের মিশন সম্পন্ন করতে সক্ষম। আরেকটি নতুন ধরনের মানববিহীন আকাশযানও প্রদর্শিত হয়েছে, যা আকাশযুদ্ধে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এই ড্রোনটিকে অত্যাধুনিক অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যার শক্তিশালী স্বাধীন আকাশযুদ্ধের ক্ষমতা রয়েছে এবং ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টে দেবে।
একটি জাহাজবাহিত মানববিহীন হেলিকপ্টারও এই কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয়েছে। এই হেলিকপ্টারটি যুদ্ধের প্রাথমিক সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান, উদ্ধার, এবং পরিবহন কাজে সক্ষম। এর পাল্লা, সহনশীলতা, এবং নমনীয়তা একই আকারের পাইলটযুক্ত হেলিকপ্টারের তুলনায় বেশি। এই হেলিকপ্টারগুলো ফ্রিগেট, ডেস্ট্রয়ার, উভচর জাহাজ, এবং বিমানবাহী রণতরীতে বহন করা যায়।