
মানুষের শরীরের মতো মস্তিষ্কও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। বয়স বাড়লে অনেকেই মনে করেন যে তাদের চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি কিংবা মনোযোগ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক অভ্যাস বজায় রাখলে মস্তিষ্ক দীর্ঘদিন সক্রিয় ও কর্মক্ষম রাখা সম্ভব।
মস্তিষ্ক আসলে এক ধরনের পেশির মতো, যত বেশি ব্যবহার করা যায় তত বেশি এর কার্যক্ষমতা বাড়ে। আর অবহেলা করলে এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তাই বয়স যাই হোক না কেন, সচেতনভাবে জীবনযাপন করলে মস্তিষ্ককে তরুণ রাখা যায়।
প্রথমেই মানতে হবে যে শারীরিক স্বাস্থ্য আর মানসিক স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে যেমন সুস্থ রাখে, তেমনি মস্তিষ্ককেও সক্রিয় রাখে। হাঁটা, হালকা দৌড়, যোগব্যায়াম বা সাঁতার মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়,
নতুন কোষ তৈরি করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা মানসিক চাপ কমায়, ঘুম ভালো হয়, মনোযোগ শক্তি বাড়ে—এসবের প্রভাব সরাসরি মস্তিষ্কে পড়ে। মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখার আরেকটি বড় উপায় হলো নতুন কিছু শেখা।
বয়স বাড়লেও শেখার ক্ষমতা কমে না, বরং এটি ধরে রাখলে মস্তিষ্ক আরও চাঙা হয়। নতুন ভাষা শেখা, নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার শেখা কিংবা বই পড়ার অভ্যাস রাখা মস্তিষ্ককে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।
এই চ্যালেঞ্জই মস্তিষ্ককে সচল রাখে। যিনি প্রতিদিন একই ধরনের কাজ করেন, তার মস্তিষ্ক একসময় একঘেয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু যিনি নিয়মিত নতুন কিছু শেখেন, তার মস্তিষ্কে নতুন সংযোগ তৈরি হয় এবং চিন্তাশক্তি দীর্ঘদিন অটুট থাকে।
সামাজিক যোগাযোগও মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একা হয়ে গেলে মানুষ দ্রুত স্মৃতিশক্তি হারায় এবং হতাশায় ভোগে। তাই পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীর সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দেওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কিংবা বিভিন্ন ক্লাবে যুক্ত থাকা মানসিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কথা বলা, গল্প শোনা বা বিতর্কে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে চিন্তাশক্তি বাড়ে এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে।
খাদ্যাভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্ক ভালো রাখতে হলে এমন খাবার খেতে হবে যাতে পর্যাপ্ত ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ, বাদাম, ফলমূল, শাকসবজি ও পরিমাণমতো পানি মস্তিষ্কের জন্য
বিশেষ উপকারী। অন্যদিকে অতিরিক্ত তেল-চর্বি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, মিষ্টি ও ফাস্টফুড মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হজমক্ষমতা কমে যায়, তাই হালকা ও পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া উচিত।
পর্যাপ্ত ঘুমও মস্তিষ্কের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয় এবং অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুছে দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে। যারা প্রতিদিন কম ঘুমান, তাদের মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি দ্রুত নষ্ট হয়। তাই বয়স যাই হোক না কেন, নিয়মিত সাত থেকে আট ঘণ্টা শান্ত ঘুম মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে।
মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ককে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। অতিরিক্ত চাপের কারণে মস্তিষ্কে কর্টিসল হরমোন বাড়ে, যা স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা জরুরি। নিয়মিত মেডিটেশন, প্রার্থনা, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম কিংবা পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে চাপ কমানো যায়।
একটি ছোট কিন্তু কার্যকর অভ্যাস হলো স্মৃতিচর্চা করা। যেমন কোনো পুরোনো কবিতা মনে করার চেষ্টা, কেনাকাটার তালিকা মুখস্থ রাখা বা দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নেওয়া। এ ধরনের ছোট্ট চর্চা স্মৃতিশক্তিকে দীর্ঘদিন সক্রিয় রাখে।
বয়স আসলে শুধু একটি সংখ্যা। মস্তিষ্ককে সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে হলে শরীরচর্চা, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত শেখার অভ্যাস ও সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা প্রয়োজন। এগুলো যদি জীবনের অংশ হয়ে ওঠে, তবে বয়স যতই বাড়ুক না কেন, মস্তিষ্ক সবসময় তরুণ ও কর্মক্ষম থাকবে।