নতুন কোনো ’হাসিনা’কে ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া ভারত

একটি ধোঁয়াসাচ্ছন্ন রাত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার কক্ষের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকারে ডুবে যান চিন্তার অতলে। দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক চাপ, মণিপুর সংকট, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা,

আর চারপাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা তাকে অজানা এক দুর্বলতার সংকেতে জর্জরিত করে তোলে। এই অস্থিরতার কেন্দ্রে এখন বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদায়ের পর,

ভারতের সেই পূর্ব-স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই অতীত হয়ে উঠছে। যে আধিপত্য একসময় দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মানচিত্রে ভারতের নিরাপত্তা বলয়কে দৃঢ় করত, তা এখন অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ভারত বারবার বলে চলেছে — বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জরুরি।

কিন্তু বিশ্লেষকদের ভাষ্য ভিন্ন। তারা বলছেন, এটি কোনো মানবিক কিংবা গণতান্ত্রিক বিবেচনা নয়; বরং এর মূলে রয়েছে ভারতের স্বার্থ-ভিত্তিক কৌশল। শেখ হাসিনার শাসনকাল ভারতকে দিয়েছিল এক ‘স্বর্ণযুগ’। ২০১০ সাল থেকে একের পর এক চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ থেকে পেয়েছে ভৌগলিক সুবিধা, নিরাপত্তা সহযোগিতা, গার্মেন্টস মার্কেটে প্রবেশাধিকার, ট্রানজিট রুট এবং ত্রিপুরা-মেঘালয় সংলগ্ন স্থলবন্দরের ওপর প্রভাব। এমনকি গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুতেও সুবিধা এসেছে হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক নমনীয়তা ও একধরনের পরাধীন নীতির কারণে।

কিন্তু সেই সূত্র আজ ছিন্ন। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসার পর ভারতীয় পক্ষ আগের মতো দাবি পূরণ পাচ্ছে না। বর্তমান প্রশাসন দেশীয় সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার কথা বলছে এবং সরাসরি বার্তা দিচ্ছে ভারতীয় প্রভাব থেকে দূরে থাকার। ফলে ভারতের সুবিধাবাদী কূটনীতি এখন ধাক্কা খাচ্ছে বাস্তবতার দেওয়ালে।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত যে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য:

ভূরাজনৈতিক প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ভারত মনে করছে, একটি নির্বাচিত সরকার দ্রুত গঠন হলে, বিশেষ করে পুরনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো ফিরে এলে, তাদের দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক দখল পুনরায় মজবুত হবে।

চীনকে ঠেকানোর ঘুঁটি: বাংলাদেশ ভারতের কাছে শুধু বন্ধু নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাব রোধে এক গুরুত্বপূর্ণ সেফ জোন। কিন্তু বর্তমান সরকার চীনের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ভারতের জন্য এলার্ম। ভারতীয় কূটনীতিকরা মনে করেন, নতুন সরকার গঠিত হলে তারা চীনা প্রভাব ঠেকাতে ভারতের সহযোগিতা চাইবে — সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় ভারত।

বাণিজ্যিক আগ্রহ: বিদ্যুৎ, ওষুধ, কৃষি ও ই-কমার্স খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবল আগ্রহ রয়েছে। নির্বাচিত সরকার যদি ভারতের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়, তাহলে এসব খাতে ভারতের অনুকূলে চুক্তি স্বাভাবিকভাবে সহজ হবে।

নদী ও গ্যাস ইস্যুতে অগ্রগতি: তিস্তা নদীর পানি বণ্টন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্যাস অনুসন্ধানের আলোচনা আগের সরকারের সময়ে এগোচ্ছিল। বর্তমানে তা স্থগিত। ভারত চায়, নতুন সরকার এলে সেই আলোচনা আবারও শুরু হোক।

সীমান্ত নিরাপত্তা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ: বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু ইউনূস সরকার যদি এই বিষয়ে দ্বিধান্বিত হয়, তাহলে ভারত আশাবাদী যে নির্বাচিত সরকার আবার সেই সহযোগিতা চালু করবে।

এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচন ভারতের কাছে শুধু একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রশ্ন নয়; বরং একটি কৌশলগত লড়াই। ভারতের আসল লক্ষ্য পুরনো সুবিধাগুলো ফিরিয়ে আনা, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, কৌশলগত অবস্থান মজবুত করা এবং সবচেয়ে বড় কথা — এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা যাকে চাপ দিয়ে ভারতের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়।

বিশ্লেষক মাসুদ কামাল যেমন বলছেন, “ভারতের মুখ থেকে যে ‘নির্বাচন চাই’, ‘শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া চাই’ বুলি শোনা যাচ্ছে, তা যেন একটা ভদ্র মুখোশ — যার আড়ালে লুকিয়ে আছে ভারতের হারানো একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।”

এ কারণে ভারতের ‘নির্বাচনের আহ্বান’ যতটা না বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য, তার চেয়েও বেশি — নিজেদের কৌশলগত পুনর্জন্মের ছক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *