
ঘুম মানুষের জীবনের এক অমূল্য অংশ। আমরা প্রতিদিন যতটা সময় কাজ করি বা বিশ্রাম নিই, তার সবকিছুর সঠিক কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘুমের উপর। ঘুম শুধু শরীরকে আরাম দেয় না, বরং মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করে। একজন মানুষ নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম না পেলে তা ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই ভাবে, একদিন বা দুইদিন ঘুম কম হলে তেমন কিছু হয় না, পরে বেশি ঘুমালে তা পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এত সহজ নয়। ঘুমের ঘাটতি জমতে জমতে মস্তিষ্কের ভেতরে স্থায়ী পরিবর্তন শুরু হয়। এই পরিবর্তনগুলো একদিকে স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল করে, অন্যদিকে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে দেয়।
মানুষের মস্তিষ্ক একটি জটিল অঙ্গ। এটি প্রতিনিয়ত তথ্য গ্রহণ, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ করে। কিন্তু এই বিশাল কাজের চাপের মাঝে মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন বিশ্রাম। সেই বিশ্রাম ঘটে ঘুমের সময়। গভীর ঘুমে গেলে মস্তিষ্ক সারাদিনের তথ্যকে সঠিকভাবে সাজিয়ে রাখে এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মেমোরি কনসোলিডেশন। অর্থাৎ ঘুমের সময় শেখা জিনিসগুলো দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে জমা থাকে। কিন্তু ঘুম কম হলে এই প্রক্রিয়া ভেঙে যায়। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ থাকে না, সহজ বিষয়ও মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক তথ্য ধারণের ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।
শুধু স্মৃতিশক্তি নয়, ঘুম কম হলে মনোভাবও নেতিবাচক হয়ে যায়। যখন পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, তখন মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণের অংশ, যাকে অ্যামিগডালা বলা হয়, তা অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর কারণে মানুষ খুব সহজে রেগে যায়, দুশ্চিন্তায় ভোগে এবং হতাশা অনুভব করে। একই সঙ্গে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, যা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, সেটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ঘুম কম হওয়া মানে শুধু মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নয়, বরং মানসিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট হয়ে যাওয়া।
আধুনিক গবেষণা বলছে, দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্কে বিষাক্ত প্রোটিন জমা হতে থাকে। এই প্রোটিনগুলো আলঝেইমার রোগের মতো মস্তিষ্কের মারাত্মক অসুখের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। স্বাভাবিকভাবে ঘুমের সময় মস্তিষ্কের ভেতর একধরনের পরিষ্কারক প্রক্রিয়া কাজ করে। এটি দিনের বেলায় জমে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলো বের করে দেয়। কিন্তু ঘুম কম হলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং স্নায়ুতে ক্ষতি হয়। এর ফলেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের স্মৃতিভ্রংশ ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ঘুম কম হওয়ার সরাসরি প্রভাব দেখা যায় মনোযোগে। যারা নিয়মিত কম ঘুমায় তারা গাড়ি চালানোর সময় বা কাজ করার সময় বারবার ভুল করে বসে। মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুম বঞ্চিত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক মদ্যপ অবস্থার মতো আচরণ করে। অর্থাৎ মানুষ বুঝতেই পারে না যে তার মস্তিষ্ক কতটা দুর্বল হয়ে গেছে। এই অবস্থায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
শিশু ও কিশোরদের জন্য ঘুমের প্রয়োজন আরও বেশি। কারণ তাদের মস্তিষ্ক এখনো বেড়ে উঠছে। ঘুম কম হলে তাদের শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়, মন খারাপ থাকে এবং শারীরিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। অপরদিকে প্রাপ্তবয়স্করা যখন ঘুম কমায়, তখন তা সরাসরি কর্মক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। অফিসে বা পড়াশোনার জায়গায় তারা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে।
আজকের জীবনযাত্রায় অনেকেই রাত জেগে মোবাইল ব্যবহার করে, টিভি দেখে বা কাজ করে। ফলে ঘুমের সময় কমে যায়। অনেকের আবার ধারণা থাকে, সপ্তাহের মধ্যে কম ঘুমালেও ছুটির দিনে বেশি ঘুমিয়ে সেটি পূরণ করা যায়। কিন্তু গবেষণা প্রমাণ করেছে, এটি সঠিক নয়। মস্তিষ্ক প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম চায়। একদিনের ঘাটতি আরেকদিন পূরণ করা যায় না। ঘুমের এই অভাব যতদিন চলতে থাকে, ততদিন মস্তিষ্কের ক্ষতি জমতে থাকে।
তাই সুস্থ মস্তিষ্কের জন্য ঘুম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ঘুম মানে শুধু বিশ্রাম নেওয়া নয়, বরং মস্তিষ্ককে নতুন শক্তি দেওয়া। ঘুম ছাড়া মানুষ তার সৃজনশীলতা, স্মৃতিশক্তি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ সবকিছুতেই পিছিয়ে পড়ে। ঘুমকে অবহেলা করার মানে হলো ধীরে ধীরে নিজের মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করা। তাই প্রতিদিন নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম নেওয়াই হতে পারে সুস্থ মস্তিষ্ক ও সুস্থ জীবনের প্রধান উপায়।