পাথর লুটে নেপথ্যে যারা, আছে রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী নেতারাও

সাদাপাথর চুরি থেকে শুরু করে ভেঙে বিক্রি করা পর্যন্ত জড়িত তিন স্তরের লুটেরা গোষ্ঠী। হাতবদলের মাধ্যমে এ পাথর চলে যেত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ তিন স্তরের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি।

এর মধ্যে রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী নেতারাও ছিলেন। লুটপাট, দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ইতোমধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদও স্থগিত করা হয়েছে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তিনটি ধাপে লুট হতো সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। লুটপাটের প্রথম ধাপে শ্রমিক, দিনমজুর,

দ্বিতীয় ধাপে ধলাই নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের ব্যবসায়ী এবং তৃতীয় ধাপে ছিলেন ক্রাসার মেশিন মালিকরা। শ্রমিক ও দিনমজুররা সাদাপাথর চুরি করে এনে ধলাই নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন।

শ্রমিকদের কেউ নৌকা হিসেবে আবার কেউ বর্গফুট হিসেবে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কাছে বোল্ডার (আস্তা) পাথর বিক্রি করে থাকে। নৌকাপ্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় আর বর্গফুট হিসেবে প্রতি বর্গফুট গড়ে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হয়।

নদীপাড়ের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা নিজেরা মজুত না করে সঙ্গে সঙ্গে সে পাথর ট্রাক ও ট্রলি দিয়ে পাঠিয়ে দেন ক্রাসার মেশিনে। ক্রাসার মেশিন মালিকরা সেই পাথর কিনে থাকেন ১১০ থেকে ১২৫ টাকা বর্গফুটে। এরপর বোল্ডার পাথর মেশিনে ভেঙে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে সেই পাথর বিক্রি করা হয়।

ক্রাসার মেশিন মালিকরা আকারভেদে সেই পাথর ১১০ থেকে ১৬০ টাকা দামে বিক্রি করে থাকেন। পাথর উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের অনেক সময় অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকেন। পাথর নিজেদের কবজায় রাখতে তারা শ্রমিকদের দাদন হিসেবেও টাকা দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। পাথর উত্তোলন থেকে শুরু করে ভেঙে বিক্রি পর্যন্ত স্থানীয় প্রভাবশালীদের ধাপে ধাপে দিতে হয় চাঁদা। তবে এই চাঁদা আদায়কারীরা সব সময় থেকে যান আড়ালে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গেল বছরের ৫ আগস্ট থেকে সাদাপাথর লুট শুরু হয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কতিপয় রাজনৈতিক নেতার মদতে।

ইতোমধ্যে লুটপাট, দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সব পদ কেন্দ্র থেকে স্থগিত করা হয়েছে। পাথর লুটের মামলায় চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিকে লুটপাটে জড়িতদের তালিকা তৈরির কাজ করছে প্রশাসন। উচ্চ আদালতও লুটপাটকারীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও লুটপাটে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ করছে বলে জানা গেছে।

সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান, পাথর লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের তালিকা এখনো হয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশও এসে পৌঁছায়নি। নির্দেশ হাতে পাওয়ার পরই তালিকা তৈরি করা হবে।

সাদাপাথর উদ্ধারে অভিযান আটক ৪, চলছে লুটও : সিলেটে সাদাপাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধারে গতকাল সিলেটের সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানকালে অন্তত ১১ হাজার ঘনফুট সাদাপাথর জব্দ করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে চারজনকে। লুটের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির প্রতিবেদন গতকাল দেওয়ার কথা থাকলেও সময় বৃদ্ধি করে বুধবার পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া পাথর লুটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশ ছিল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান।

এদিকে, সাদাপাথর উদ্ধারে অভিযান চললেও এখনো জৈন্তাপুরের রাঙপানি পর্যটন কেন্দ্রে লুট চলছে। নদী ও পাড়ের মাটি খুঁড়ে পাথর লুট করছেন স্থানীয়রা। গতকাল সালুটিকর ভাটা এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আরডিসি আশিক মাহমুদ কবীরের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে মাটিচাপা অবস্থায় প্রায় ১১ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। একটি ক্রাশার মেশিনের আঙিনায় মাটিচাপা অবস্থায় পাথরগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অভিযানকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করা হয়।

জাফলংয়েও পাথর উদ্ধার : জাফলংয়েও লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মো. ফরহাদ উদ্দিনের নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে জাফলংয়ের জুমপাড় এলাকা থেকে দেড় হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। পরে ওই পাথর জাফলং জিরোপয়েন্ট পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে বালু ও পাথর উত্তোলনে নিয়োজিত ৫০টি নৌকা ধ্বংস করা হয়।

রাঙপানিতে চলছে লুট : ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর ও জাফলং জিরোপয়েন্ট থেকে লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলছে। প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে মূল্যবান পাথর। উদ্ধারকৃত পাথর ফের নদীতে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে জৈন্তাপুরের রাঙপানি এলাকায় চলছে পাথর লুট। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, রাঙপানি নদী থেকে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করছেন। কেউ কেউ নদীর তীরবর্তী এলাকা খুঁড়ে পাথর তুলছেন। সংবাদকর্মীদের দেখে একপর্যায়ে পাথর উত্তোলনকারী শ্রমিকরা পালিয়ে যান। তবে দিনভর সেখানে প্রশাসনকে অভিযান চালাতে দেখা যায়নি।

বাড়ল তদন্তের সময় : সাদাপাথর লুটের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছিল পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। গতকাল কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় বুধবার পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।

পাথর ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেফতার ৪ : সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টাস্কফোর্সের বিশেষ অভিযানে বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র ও মদসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত ১২টার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল মাহমুদ ফুয়াদের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে রাত ১টার দিকে ভোলাগঞ্জ আদর্শ গ্রামে পাথর ব্যবসায়ী কুতুব উদ্দিন ওরফে পাগলা শাহর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তার বাড়ি থেকে একটি দা, দুটি ছোরা, একটি বল্লম, ভারতীয় মদ ও একটি এয়ারগান জব্দ করা হয়। এসময় পাগলা শাহকে আটক করা হয়। রাত সোয়া ২টার দিকে ভোলাগঞ্জ উত্তরপাড়া এলাকার মো. আবদুল ওয়াহিদের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। বাড়ি থেকে জব্দ করা হয় একটি বল্লম, ১টি রামদা, একটি ছুরি ও একটি দা। এ সময় আবদুল ওয়াহিদ ও তার ছেলে রুয়েল আহমদ ও জাহিদ আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *