
রাশিয়া সোমবার জানায়, পরিবহনমন্ত্রী রোমান স্তারোভইত আত্মহত্যা করেছেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে বরখাস্ত করেন। রুশ সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে, ইউক্রেনের আক্রমণের শিকার কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চলের সাবেক
গভর্নর রোমান স্তারোভইতের মরদেহ তার গাড়ির ভেতরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। রাশিয়ার তদন্ত কমিটির মুখপাত্র স্বেতলানা পেত্রেঙ্কো জানান, “আত্মহত্যাকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, তদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে কাজ করছে।
তবে তার মৃত্যুর সময় ও স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি জঙ্গলঘেরা এলাকা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে।
কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শনিবার গভীর রাতে বা রোববার ভোরে তার মৃত্যু হতে পারে।
সোমবার, ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৫৩ বছর বয়সী স্তারোভইতকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে বরখাস্তের কোনও কারণ জানানো হয়নি।
এর আগের সপ্তাহান্তে, ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বহু যাত্রী বিমানবন্দরে আটকে পড়েন, বাতিল হয় বহু ফ্লাইট।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, বরখাস্তের সিদ্ধান্তের পেছনে স্তারোভইতের প্রতি আস্থা হারানোর বিষয় নেই।
তবে রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই মৃত্যু নিয়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, স্তারোভইতের বিরুদ্ধে কুরস্কে প্রতিরক্ষা স্থাপনা নির্মাণের অর্থ আত্মসাতের তদন্ত চলছিল।
২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত কুরস্কের গভর্নর ছিলেন স্তারোভইত। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে অঞ্চল দখল করার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন।
সে সময় ইউক্রেনীয় সেনারা ১,০০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা দখলে নেয়।
এপ্রিল মাসে, স্তারোভইতের উত্তরসূরি গভর্নর আলেক্সেই স্মিরনভকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাশিয়ার বেসরকারি সংবাদমাধ্যম ‘রসবিজনেস কনসালটিং (আরবিসি)’ জানিয়েছে, এই কেলেঙ্কারিতে স্তারোভইতের সম্পৃক্ততা নিয়েও তদন্ত চলছিল। ইউক্রেনীয় আক্রমণে রুশ ব্যর্থতার জন্যও তাদের দায়ী করা হচ্ছিল।
রুশ সংবাদপত্র ‘কোমারসান্ত’ জানিয়েছে, এই মামলায় স্মিরনভ স্তারোভইতের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মৃত্যুর আগে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিমিত্রি ইলোভস্কি ‘কোমারসান্ত’কে বলেন, “এই ঘটনা তার (স্তারোভইতের) ওপর এক বিশাল ছায়া ফেলছে।”
তিনি বলেন, “জনমনে এখন একটাই প্রশ্ন—যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে, তবে সেই সময়ের গভর্নরের দায় কতটা?”
তাসের বরাতে জানা যায়, স্তারোভইতের গাড়ি টেসলা মডেল এক্স থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে, যা তাকে ২০২৩ সালে রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।
রাশিয়ার রাজনীতিকরা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে জানান, এই রহস্যমৃত্যু মস্কোয় ভয় ও শঙ্কা ছড়িয়ে দেবে।
একজন বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই ঘটনা আমাদের সকলের জন্য, পুরো ব্যবস্থার জন্য, অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এক সংকেত।”
আরেক কর্মকর্তা বলেন, “কিছু মানুষ ভয় পাবে, কেউ কেউ হতাশ হবে, আর যাদের ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে, তারা আরও শঙ্কিত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ভাবছিলাম, রাশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে এরকম ঘটনা কবে ঘটেছিল? মনে পড়ল ১৯৯১ সালের কথা, যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস পুগো ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর আত্মঘাতী হয়েছিলেন।”
মস্কো এখন নিজেদের দলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে।
সোমবারই, রুশ সেনাবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান খালিল আর্সলানভকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প থেকে ১ বিলিয়ন রুবল (৯৪ লাখ পাউন্ড) আত্মসাতের অভিযোগে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী তিমুর ইভানোভকে ব্যাংক জালিয়াতি ও কের্চ প্রণালির ফেরি কেনার জন্য বরাদ্দ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী কনস্তান্তিন স্ত্রুকোভকে তার ৫ কোটি ডলারের ব্যক্তিগত বিমানে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে খনি ঠিকাদারি ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের জ্যেষ্ঠ গবেষক আলেক্সান্ডার বাউনভ বলেন, স্তারোভইতের মৃত্যু হয়তো একটি ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
তিনি ফেসবুকে লেখেন, “ক্ষমতাসীনরা হয়তো বার্তা দিতে চেয়েছে—যারা নিয়ম ভাঙে কিংবা বেশি কিছু জানে, তারা চূড়ান্ত মূল্য দিতে বাধ্য।”
এক সাবেক ক্রেমলিন কর্মকর্তা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-কে বলেন, “যদি এটি হত্যাকাণ্ড হয়, তবে রাশিয়ার শাসনব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।”
তিনি বলেন, “এর অর্থ হবে—এখন আইনের বাইরে সহিংসতারও অনুমোদন রয়েছে, যেখানে আইন দুর্নীতিকে সঠিকভাবে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারছে না। এতে করে কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা আরও কমে যাবে।”
স্তারোভইত ছিলেন পুতিনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরের সদস্য, তবে তিনি পুতিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু আরকাদি ও বরিস রোটেনবার্গের সঙ্গে কাজ করতেন, যারা পুতিনের জুডো প্রশিক্ষণের সঙ্গী।
সেই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “এই ঘটনা হয়তো দেখাচ্ছে, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পুতিন তাদের কিছুটা পাশ কাটিয়ে রেখেছেন।”
সোমবার বিকেলে আরও এক পরিবহন কর্মকর্তার মৃত্যুর খবর ছড়ায়।
টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘বাশ’, ‘মাজা’, ‘শট’ ও ‘১১২’ জানায়, রাশিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-প্রধান আন্দ্রে করনেইচুক মন্ত্রণালয়ের দপ্তরেই আকস্মিকভাবে পড়ে যান। তবে সরকারি সূত্রে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।
৪২ বছর বয়সী করনেইচুক নাকি হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা জানান, তার মৃত্যু হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হয়ে থাকতে পারে।