ইসরায়েলের পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছিলো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র

সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের অন্তত পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে সরাসরি আঘাত হেনেছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ। হাতে আসা স্যাটেলাইট রাডার তথ্যের ভিত্তিতে এই চাঞ্চল্যকর দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমটি। এসব হামলার ঘটনা ইসরায়েল সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, এবং সামরিক বাহিনীর কড়া বিধিনিষেধের কারণে দেশটির কোনো সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে খবর প্রকাশ করতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই রাডারচিত্রগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে বোমার ক্ষয়ক্ষতি শনাক্তে বিশেষজ্ঞ। তারাই বিষয়টি দ্য টেলিগ্রাফকে জানান। তথ্য অনুযায়ী, উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকার পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় ইরানের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যে হামলাগুলোর তথ্য এর আগে প্রকাশ্যে আসেনি।

এর মধ্যে একটি বড় বিমানঘাঁটি, একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ কেন্দ্র এবং একটি লজিস্টিক ঘাঁটি রয়েছে। লজিস্টিক ঘাঁটি বলতে এমন একটি সামরিক ঘাঁটি বা কেন্দ্রকে বোঝায়, যেখানে যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, রসদ, জ্বালানি, অস্ত্র, যানবাহন ও অন্যান্য সহায়ক উপকরণ মজুত, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েলের সরকারিভাবে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র তুলে ধরছে, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। দ্য টেলিগ্রাফের পক্ষ থেকে গত শুক্রবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) কাছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলেও,

তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। আইডিএফের একজন মুখপাত্র শুধু বলেছেন, “আমরা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বা ঘাঁটির ক্ষতির বিষয়ে কিছু বলব না। তবে যা বলতে পারি, তা হলো অভিযানের পুরো সময়জুড়ে সংশ্লিষ্ট সব ইউনিট কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম ছিল।”

পাঁচটি সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইসরায়েলের আরও ৩৬টি স্থানে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যা দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে আবাসিক ও শিল্প কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করেছে। ইসরায়েলজুড়ে আবাসিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সত্ত্বেও দেশটির মাত্র ২৮ নাগরিক নিহত হয়েছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলের উন্নত সতর্কতাব্যবস্থা এবং জনগণের ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খলভাবে আশ্রয়কেন্দ্র (বোম্ব শেল্টার) ও নিরাপদ কক্ষ ব্যবহারের ফলেই তুলনামূলক কম মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।দ্য টেলিগ্রাফের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর অধিকাংশই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করতে ব্যর্থ হলেও, যুদ্ধের প্রথম আট দিন থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।

তখন থেকে প্রতিহত হওয়া ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে গিয়ে আঘাত হানার অনুপাত বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বেশি পরিমাণে ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করতে পারল, তা স্পষ্ট নয়। তবে এর কারণ হতে পারে, ইসরায়েল তাদের সীমিত ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র (ইন্টারসেপ্টর) রয়েসয়ে ব্যবহার করছিল অথবা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পদ্ধতি উন্নত হয়েছে এবং তারা হয়তো বেশি পরিমাণে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল।

ইসরায়েলের সবচেয়ে পরিচিত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নাম হলো আয়রন ডোম, যা মূলত মর্টার ও রকেটের মতো স্বল্পপাল্লার প্রজেক্টাইল থেকে সুরক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি ইসরায়েলের ‘বহুস্তরীয়’ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার একটিমাত্র অংশ। মাঝের স্তরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ডেভিড’স স্লিং সিস্টেম রয়েছে, যা ড্রোন এবং ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি। একেবারে ওপরের স্তরের জন্য আছে অ্যারো সিস্টেম, যা দীর্ঘ দূরত্বের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসার আগেই ধ্বংস করে ফেলে। এই ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্রও। ইরানের হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি থাড (টিএইচএএডি) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং লোহিত সাগরে থাকা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র কমপক্ষে ৩৬টি থাড ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, যার প্রতিটির খরচ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

ইসরায়েল একটি ঘনবসতির ছোট দেশ, যার জনসংখ্যা মাত্র ৯৭ লাখ। দেশটির বিখ্যাত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ হওয়ায় অনেকে ব্যাপক বিস্মিত হয়েছেন। সরকারও সতর্ক করে বলেছে, এই ব্যবস্থা ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *