সেদিন ছিল শুক্রবার, তারপর থেকে বদলে যায় খামেনির জীবন

আয়াতুল্লাহ আলি হোসেইনি খামেনি ইরানের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিরোধপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময়ে তিনি ইরানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চেহারা দৃঢ়ভাবে নির্ধারণ করেছেন। তিনি তার জীবন, রাজনীতি ও বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

আলি হোসেইনি খামেনি ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল ইরানের মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম এক সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষকের পরিবারে। ২০ বছর বয়সে নাজাফ ও কুম ইমামতের উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সেখানে তিনি লোকজীবন, দর্শন ও ইসলামিক প্রশাসন বিষয়ে পরবর্তী পরিশীলিত জ্ঞান লাভ করেন।

শাহ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কারাবাস ও নির্বাসন

খামেনি শাহ মুহাম্মাদ রেজা পেহলভির বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। এ কারণে তাকে ছয়বার গ্রেপ্তার করা হয় ও তিন বছর নির্বাসিত থাকার কথা বলা হয়।

তার জীবন বদলে যায় ১৯৮১ সালের ২৭ জুনের এক ঘটনার মাধ্যমে। সেদিন ছিল শুক্রবার, তিনি তেহরানের আবুজার মসজিদে নামাজে উপস্থিত হন এবং যুদ্ধফ্রন্ট থেকে ফিরে এসে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা শেষে তিনি কিছু যুবকের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি সাংবাদিক সেজে একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে তার সামনে রাখে। কিছুক্ষণ পর সেই রেকর্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। পরে জানা যায় এটি ছিল একটি বোমা, যাতে লেখা ছিল : ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য ফরকান গ্রুপের উপহার।’

এই হামলায় তার ডান হাত চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় এবং গলার স্বরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাকে দ্রুত বাহারলু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানা যায়, এই ফরকান গ্রুপ ছিল এক গোপন চরমপন্থি সংগঠন, যারা শিয়া ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত।

এই হত্যাচেষ্টা ছিল ইরানের রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি উদাহরণ। তখন ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। ইসলামি রিপাবলিকান পার্টি ও বিপ্লববিরোধী এমকেও সংগঠনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল। এমকেও শুরুতে শাহের বিরুদ্ধে ছিল, কিন্তু পরে ইসলামি শাসনের বিরোধিতা করে।

এই ঘটনার পরদিনই ২৮ জুন, আইআরপি কার্যালয়ে আরেকটি বড় বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন ২৭ সংসদ সদস্য ও বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ বেহেশতি। এসব ঘটনার জন্য সরকার এমকেওকে দায়ী করে, যদিও তারা দায় স্বীকার করেনি।

তবে এ সময়টি তাকে রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় হতে সহায়তা করে।

রাষ্ট্রপতি থেকে সর্বোচ্চ নেতা

ইসলামি বিপ্লবের (১৯৭৯) পর তিনি শরিক সুরক্ষা পরিষদের সদস্য ও পরবর্তীতে বিপ্লবী অভ্যন্তরীণ রক্ষাকারী বাহিনীর সহপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯৮১–৮৯ সাল পর্যন্ত দুই দফা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেইনির মৃত্যুর পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন তিনি। যদিও তখন তিনি মারজা ধর্মীয় তকমা ছাড়া ছিলেন, যা বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল সে সময়।

অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিস্তার

তার শাসনের অধীনে এ সংহত ক্ষমতা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অনুগতদের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। যেমন- বিচার বিভাগ, মধ্যস্থতাকারী কাউন্সিল ও রেবেলিয়ন রক্ষাকারী বাহিনীমন্ডল। ২০০৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে গুরুতর পদক্ষেপ নিয়ে তিনি আলোকপাতযোগ্য বিরোধমুখ নীতি গ্রহণ করেন।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব

খামেনির নেতৃত্বে ইরান ‘প্রতিরোধের অর্থনীতি’ এবং ‘প্রতিরোধের কূটনীতি’ ভূমিকা পরিচালনা করে। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, গাজা ও ইরাকের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ নেটওয়ার্ক তার আন্তর্জাতিক কূটনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়।

পারমাণবিক ফাতওয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব

তিনি ২০০৩ সালে প্রকাশিত এক ফাতওয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র না ধারণের নৈতিক ভিত্তি তুলে ধরেন, যদিও অনেকে এর দাপ্তরিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক আলোচনায় এটি ইরানের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য প্রমাণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

সংকট: অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপ

বর্তমানে তিনি চলমান ইসরায়েল ও ইরান সংঘর্ষ, অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ ও অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসে তার অভ্যন্তরীণ পরামর্শদাতারা হামলা-পাল্টা হামলায় নিহত হন। ফলে তার পদক্ষেপগুলো আরও সংকটময় ও দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। যদি তার কিছু হয়ে যায় তবে, তার পুত্র মজতবা খামেনিকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইরানের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামো তিনি দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞান এবং আঞ্চলিক কূটনীতির মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ বাধাবিপত্তি, আন্তর্জাতিক চাপ ও উত্তরাধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও, তার শাসন পরবর্তী সময়েও আলোচিত থাকবে।

তথ্যসূত্র: দ্য জেরুজালেম পোস্ট, বিবিসি, ইন্ডিয়া টুডে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *