বেসরকারি অর্ধলক্ষ শিক্ষক ও কর্মচারীর কান্না

বছরের পর বছর ধরে ছাত্রদের পড়িয়েছি। এখন মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি শিক্ষক হয়ে। কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখের কোণে পানি জমে আসে রাশেদা বেগমের (৬৫)।

তিনি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্যে গর্বিত হলেও অবসরে এসে দিশেহারা। অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য কয়েক মাস ধরে রাজধানীর পলাশীতে ‘বে‍সরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে’ ঘুরছেন।

আশা নেই। স্বামী মারা গেছেন বহু বছর আগে। সংসার চালাতে ছেলেমেয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। প্রাপ্য অর্থ যদি হাতে আসত, অন্তত চিকিৎসা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ করতে পারতেন।

রাশেদা বেগম একা নন–সারাদেশের প্রায় অর্ধলাখ অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীর অবস্থা একই।সিরাজগঞ্জের বেলকুচির শিক্ষক নুরুল ইসলাম (৭০)। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা শেষে অবসর নিয়েছেন।

তিনি কষ্টের সঙ্গে বললেন, ‘চোখের চিকিৎসা দরকার। ডাক্তার বলেছেন, দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। হাতে টাকা নেই। অবসর ভাতার টাকার জন্য চার মাস আগে আবেদন করেছি। ফাইল ঢাকায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে এক টুকরো জমি বেচেছি।’

অবসর ভাতা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ কম হওয়ায় নতুন আবেদনকারীরা প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না। পুরোনো আবেদনগুলো আটকে আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

শিক্ষকতার গৌরব, অবসরের অনিশ্চয়তা

গ্রামগঞ্জে শিক্ষককে এখনও সম্মান করা হয়। এ সামাজিক মর্যাদার আড়ালে লুকিয়ে আছে অবসরের পর হতাশার গল্প। অনেকে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, অনেকে চিকিৎসার টাকা না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন।

কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শুধু চলতি অর্থবছরে কয়েক হাজার শিক্ষক ভাতা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। অর্থ না থাকায় ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফাইলগুলো আটকে থাকছে। অনেক শিক্ষক জীবিত অবস্থায় প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না।

সংকটের মূলে অর্থের অভাব

সারাদেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণ সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে আবেদন জমেছে প্রায় ৪৭ হাজার ৩২৯টি।

অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে জানা গেছে, টাকা দিতে সাড়ে তিন থেকে চার বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদনগুলোর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত জমার বিপরীতে টাকা দেওয়ার অনুমোদন করা হয়েছে। কলেজে তা ওই বছরের মার্চ পর্যন্ত এবং মাদ্রাসার জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসের আবেদন এখন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কল্যাণ ট্রাস্টের একজন কর্মকর্তা জানান, অনুমোদনের পরও কখনও কখনও টাকা পেতে কিছু সময় লেগে যায়।

অবসর ও কল্যাণ সুবিধার বড় অংশ আসে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে। বর্তমানে অবসর সুবিধার জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটা হয়। কল্যাণ সুবিধার জন্য ৪ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয়। এ ছাড়া সরকার মাঝেমধ্যে থোক বরাদ্দ দেয়। এফডিআরের লভ্যাংশ এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে কেটে রাখা টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকা দেওয়া হয়।

অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৬ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে মাসে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা আদায় হয়। এফডিআর থেকে মাসে আয় হয় ৫ কোটি টাকা। এই দুই খাতে মাসে আয় হয় ৮০ কোটি টাকা, যা বছরে ৯৬০ কোটি টাকা। শুধু অবসর সুবিধার জন্য মাসে প্রয়োজন হয় ১১৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে মাসে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে; যা বছরে ৪২০ কোটি টাকা।

অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক জাফর আহমেদ সমকালকে জানান, যদি অনিষ্পন্ন সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে হয়, তাহলে প্রায় পাঁচ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা লাগবে। এরপর স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিলে কাউকে আর অবসর সুবিধার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

অন্যদিকে, কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব ড. শরিফা নাছরীন বলেন, অনিষ্পন্ন আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে এককালীন ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা দরকার। এরপর প্রতিবছর সরকার ২০০ কোটি টাকা দিলে স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

শিক্ষকদের ক্ষোভ

শিক্ষক নেতারা বলছেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী অবসরের পর পেনশন সুবিধা পান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা, যাঁরা সারা জীবন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন, তাঁদের অবসরে ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই।

শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুঁইয়া সমকালকে বলেন, ‘আমরা আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তুলি। অথচ নিজেরা অবসরে এসে অন্ধকারে ডুবে যাই। এটি শুধু অর্থ সংকট নয়, শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলার চরম উদাহরণ।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষকদের মনোবল ধরে রাখতে হলে অবসর-পরবর্তী সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকরা যাতে মর্যাদা ও নিশ্চয়তার সঙ্গে অবসর জীবন কাটাতে পারেন, তার জন্য সরকারি উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *