
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেন, শরীরের অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ছেঁকে ফেলে এবং প্রয়োজনীয় অংশ ধরে রাখার কাজ নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছে কিডনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিলিটার রক্তে প্রায় দেড় চা-চামচ পরিমাণ লবণ মিশ্রিত থাকে। কিডনি এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে ৫ শতাংশ সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখে, খাদ্যাভ্যাস প্রতিদিন যতই ভিন্ন হোক না কেন। এত নিখুঁত ও কার্যকর কাজ শরীরের আর কোনো অঙ্গের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, কিংবা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগে আক্রান্ত হলে কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। তখন খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া জরুরি হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে ভারতের বেঙ্গালুরুর অ্যাপোলো হাসপাতালের সিনিয়র কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. প্রকাশ সি ধীরেন্দ্র জানিয়েছেন, কিডনি রোগীদের কিছু নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রনিক কিডনি রোগ শুধু ব্যক্তিগত নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি; কারণ এটি হৃদরোগ, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যুহারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
পানি
কিডনি রোগীরা পানির পরিমাণ নিয়ে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া উচিত। ইন্টারনেটে অনেক ভিডিওতে দাবি করা হয় যে প্রচুর পানি খেলেই কিডনি রোগ সেরে যায়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে অতিরিক্ত পানি শরীর থেকে বের করতে কিডনির সক্ষমতা হারায়। ফলে শরীরে পানি জমে গিয়ে পা ফুলে যায় (ইডিমা), পুরো শরীর ভারী হয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে ভয়াবহভাবে ফুসফুসে পানি জমে (পালমোনারি ইডিমা) প্রাণঘাতী অবস্থা তৈরি হতে পারে। হৃদরোগ ও লিভারের সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্যও একই সতর্কতা প্রযোজ্য।
অতিরিক্ত পানি খাওয়ার আরেকটি বিপজ্জনক প্রভাব হলো রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া বা হাইপোন্যাট্রেমিয়া। প্রবীণদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি এবং গুরুতর হলে তা জীবনহানির কারণ হতে পারে।
লবণ
খাবারে বাড়তি লবণ দেওয়ার প্রয়োজন কেবল স্বাদের জন্য। স্বাভাবিক খাবারেই যে পরিমাণ সোডিয়াম থাকে, তা শরীরের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের জন্ম দেয়, যা থেকে কিডনি বিকল, হৃদরোগ ও পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধও যথাযথভাবে কাজ করে তখনই, যখন লবণের ব্যবহার সীমিত রাখা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, লবণ কমানো একটি কম খরচের কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অত্যন্ত কার্যকর জীবনযাপন পরিবর্তন।
ফলমূল
কিডনি রোগীরা সাধারণত রক্তে উচ্চমাত্রার পটাশিয়ামের ঝুঁকিতে থাকেন, যা পেশি ও হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। বেশিরভাগ ফল পটাশিয়ামে সমৃদ্ধ। তবে আপেল, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাকবেরি, আনারস, নাশপাতি ও আঙুর তুলনামূলক কম পটাশিয়ামযুক্ত ফল, যা সীমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে।
অতিরিক্ত প্রোটিন
ক্রনিক কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে প্রোটিনকে প্রায়শই ক্ষতিকর হিসেবে দেখা হয়। এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। শরীরের জন্য প্রোটিন অপরিহার্য। তবে মাত্রাতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ কিডনির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। তাই ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। সাধারণ ভারতীয় খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের মাত্রা অনেকটাই কম, বিশেষত নিরামিষভোজীদের ক্ষেত্রে। ফলে তাদের ক্ষেত্রে বাড়তি প্রোটিনের বদলে সঠিক পরিমাণে গ্রহণই বেশি উপযোগী।
কচি নারকেল
কচি নারকেলে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে। তাই কিডনি রোগীদের একেবারেই এড়িয়ে চলা বা সীমিতভাবে গ্রহণ করা উচিত।
অবৈজ্ঞানিক ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট
আজকাল বাজারে অসংখ্য ভেষজ বা ম্যাজিকাল সাপ্লিমেন্টের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে আছে। কিডনি রোগীরা সহজেই এসব ভুয়া চিকিৎসকদের ফাঁদে পড়েন, কারণ এই রোগ ধীরে ধীরে বহু বছর ধরে অগ্রসর হয়। অবৈজ্ঞানিক এসব চিকিৎসার ফলে কিডনি দ্রুত নষ্ট হয়ে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন পর্যন্ত হতে পারে। তাই যে কোনো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে সতর্ক থাকা জরুরি। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই অন্য রোগ আছে কিংবা যাদের পরিবারের কারও কিডনি সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া আবশ্যক।
কিডনি রোগীরা দৈনন্দিন জীবনে যে ছয়টি খাবার নিয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে, সেগুলো হলো পানি, লবণ, বেশিরভাগ ফলমূল, অতিরিক্ত প্রোটিন, কচি নারকেল এবং ভুয়া সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ। তবে এটি কেবল একটি সাধারণ নির্দেশনা। কারও নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকার প্রয়োজন হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সুস্থ কিডনি মানেই সুস্থ জীবন।
সূত্র:https://tinyurl.com/48xypxch