লন্ডনে ড. ইউনূসের নাগরিক সংবর্ধনা বাতিলের নেপথ্যে কী?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্রিটেন সফরে প্রবাসীদের সঙ্গে ‘মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও সেটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নাগরিক সংবর্ধনা বাতিলের নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা। নানা কূটকৌশল অবলম্বণ করে তারা এই অনুষ্ঠানকে বাধঅগ্রস্ত করেছে।

জানা গেছে, ব্রিটেন প্রবাসী শাহগির বখত ফারুক, সিলেট সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের দোসরা নানাভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকা ও তাদের সকল অপশক্তি দিয়ে ইউনূস সরকারের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বাংলাদেশে বিশ্বের বুকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লন্ডনে ড. ইউনূসের নাগরিক সংবর্ধনা বাতিল করিয়েছে তারা।

রাজা তৃতীয় চার্লসের আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে বৃটেনে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চার দিনব্যাপী এই সফরে বাকিংহাম প্যালেসে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। এ সময় রাজা চার্লসের হাত থেকে তৃতীয় ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করবেন প্রধান উপদেষ্টা।

সফর শেষে আগামী ১৪ জুন দেশে ফিরবেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে দ্বিপক্ষীয় সফর বলে ঘোষণা দিয়েছে বৃটিশ সরকার। সে অনুযায়ী ১১ই জুন ড. ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে সপ্তাহব্যাপী চলছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানাতে একের পর এক প্রস্তুতি সভা চালিয়ে যাচ্ছে।

সরকার প্রধানকে স্বাগত জানাতে উৎসাহের সাথে বৃটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতারা একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় করে যাচ্ছেন। প্রবাসীরা মনে করছেন প্রধান উপদেষ্টার এই সফর প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। সফরকালে প্রবাসীদের নানা দাবি-দাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরবেন প্রবাসীরা।

হাইকমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার প্রধানকে বরণ করতে সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করেছে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম বলেন, ‘হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ পুরস্কার বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের আরো উন্নয়ন এবং সহযোগিতার প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে।

তবে প্রবাসীদের এত উৎসাহ-উদ্দীপনায় ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে, কারণ আগামী ১২ জুন প্রবাসীদের সঙ্গে ‘মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠান ছিল প্রধান উপদেষ্টার। তবে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে এমন কারণ জানিয়ে বাতিল করা হয়েছে অনুষ্ঠানটি।

ফলে অনেক দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলা থেকে বঞ্চিত হলেন প্রবাসীরা এমনটি মনে করছেন বৃটিশ বাংলাদেশিরা। তবে নিরাপত্তার শক্তিশালী দেশে হঠাৎ করে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কেন বাতিল করা হলো ‘মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠান? এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য।

সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের সিদ্ধান্তের পর বিবিধ বিষয়ে আলোচনার জন্য উপদেষ্টা পরিষদ একটি বৈঠকে বসে। লন্ডনে প্রবাসীদের সাথে মতবিনিময় হবে কিনা এ বিষয়ে আলোচনা হলে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় প্রবাসীদের সাথে মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা নেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তবে মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা আয়োজনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় কমিউনিটির মানুষের সাথে সমন্বয় করতে দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দেবেন এমন প্রশ্নে লন্ডন প্রবাসী শাহগির বখত ফারুককে দায়িত্ব দিতে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই প্রস্তাব করেন।

এমন সিদ্ধান্তের পর পররাষ্ট দফতর থেকে লন্ডনস্থ হাইকমিশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়- মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজনের সকল দায়িত্ব শাহগির বখত ফারুককে দেয়ার জন্য। সেই মোতাবেক শাহগির বখত ফারুক অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করে কমিউনিটির ব্যবসায়ী সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ সবার সহযোগিতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা আয়োজনের কাজ শুরু করেন।

এক পর্যায়ে তারিখ-স্থান নির্ধারণও হয়। আগামী ১২ই জুন দ্য গিল্ডহল , সিটি অব লন্ডন হলে অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল। তবে গত ৬ই জুন আয়োজক প্রধান শাহগির বখত ফারুক কমিউনিটির নেতৃবৃন্দকে একটি টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, যুক্তরাজ্য সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে প্রাবসীদের মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা বাতিল করা হয়েছে। সেখানে কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার কারণেই অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে।

নির্ধারিত মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা বাতিলের কারণ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করলেও কী ধরনের ‘নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার ঘাটতি’ রয়েছে এমন কোনো কিছু প্রকাশ করেননি আয়োজক শাহগির বখত ফারুক। তবে সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরকে প্রতিহত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।

এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ। মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি করতে আগামী ১২ জুন দ্য গিল্ড হল , সিটি অব লন্ডন বুকিং করেন শাহগির বখত ফারুক, তবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ দাবি করছে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাধান উপদেষ্টাকে নিয়ে উক্ত হলে অনুষ্ঠান করতে দিলে হলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

সেখনে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে হল কর্তৃপক্ষকে কয়েক ডজন ইমেইল করে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও বেশ কিছু সংগঠন এবং কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব। বিধায় হল কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানটির বুকিং বাতিল করে।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আরো দাবি করেছে যে, শুধু দ্য গিল্ডহল, সিটি অব লন্ডন নয় আরো একাধিক হলেও অনুষ্ঠানটি করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তাদের আপত্তির কারণে লন্ডনের কোনো হলই বুকিং নেয়নি।

যার ফলে আগামী ১২ই জুন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে প্রবাসীদের মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়নি। তবে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি বাতিলের সুস্পষ্ট কারণ জানায়নি বাংলাদেশ হাইকমিশন।

কে এই শাহগির বখত ফারুক?

শাহগির বখত ফারুক সুনামগঞ্জ জেলার সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ঐতিহাসিক বখত পরিবাবের সন্তান। কয়েক দশক যাবৎ তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তার পরিবারের সদস্য প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বলা যায়, কট্টর আওয়ামীপন্থী পরিবার।

শাহগির বখত ফারুকের পরিবারের সদস্য মনোয়ার বখত নেক ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও পৌরসভা চেয়ারম্যান (সাবেক)। আরেক চাচাতো ভাই জগলুল বখত ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভা চেয়ারম্যান (সাবেক), আরেক চাচাতো ভাই পলিন বখত সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, অন্য চাচাতো ভাই নাদের বখত পৌরসভা চেয়ারম্যান। সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শাহগির বখত ফারুক।

শাহগির বখত ফারুক বাংলাদেশি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। তবে ব্রিটিশ রাজনীতির সাথে তিনি ওঁতপতভাবে জড়িত। যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টি থেকে এমপি নির্বাচন করেছিলেন তিনি। তিনি ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা। তিনি ‘গণশক্তি’ পরিষদের যুক্তরাজ্য শাখার আহ্বায়ক ছিলেন।

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে শাহগির বখত ফারুকের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, একাধিক সূত্র বলছে শাহগির বখত ফারুক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু। সে সুবাধেই তাঁকে এই দায়িত্ব দেন মুহাম্মদ ইউনুস। সফরকালে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে যে টাকা পাচার করা হয়েছে, সেগুলো উদ্ধারের বিষয়েও আলোচনা হবে। ড. ইউনূসের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন। তথ্যসূত্র: মানবজমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *