বিশ্ববাজারে সোনার দাম রেকর্ডে!

২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বাণিজ্য যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বে নড়বড়ে বিনিয়োগ বাজারে সোনা এখন একমাত্র স্থিতিশীল সম্পদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, হেজ ফান্ড ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সোনার দিকে ঝুঁকলেও, খুব কম মানুষ জানেন—এই সোনা কোথা থেকে আসে, আর কতটা রক্ত ঝরে এর পেছনে।

বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের তিনটি সামরিক শাসিত দেশ—বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজারে—সোনাই এখন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। জিহাদি হামলা, জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মাঝে এই দেশগুলো সোনাকে রাজনৈতিক ও সামরিক টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিশ্ব স্বর্ণ পরিষদের (World Gold Council) হিসেবে, তিনটি দেশের সম্মিলিত সোনার উৎপাদন বছরে প্রায় ২৩৩ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। তবে খনির তথ্য স্বচ্ছ না হওয়ায় প্রকৃত উৎপাদন আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

‘সার্বভৌমত্ব’ না কি বিদেশি প্রভাব?
স্থানীয় সরকারগুলো দাবি করছে, সোনা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব সরাসরি জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় “সার্বভৌমত্ব” বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর পরিবর্তে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো সোনার খনিতে ব্যাপকভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করছে।

উদাহরণস্বরূপ, মালি সম্প্রতি একটি নতুন স্বর্ণ পরিশোধনাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে, যেখানে রাশিয়ান ইয়াদরান গ্রুপের অংশীদারিত্ব রয়েছে। প্রকল্পটি ৫০০ সরাসরি ও ২,০০০ পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে দাবি করা হচ্ছে।

বুরকিনা ফাসো প্রথমবারের মতো একটি জাতীয় স্বর্ণ পরিশোধনাগার নির্মাণ করছে। এ ছাড়া সেখানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত খনি কোম্পানি গঠিত হয়েছে, যার আওতায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবসার ১৫% অংশ সরকারকে দিতে হবে এবং স্থানীয় জনগণকে দক্ষতা হস্তান্তর করতে হবে।

এই উদ্যোগকে ঘিরে সরকারের পক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (AI-generated) প্রচারণা শুরু হয়েছে, যেখানে জনপ্রিয় তারকার কণ্ঠে তৈরি গানের মাধ্যমে বুরকিনা ফাসোর তরুণ সামরিক নেতা ইব্রাহিম ট্রাওরেকে প্রশংসা করা হচ্ছে।

স্বর্ণে অর্থ, স্বর্ণে সহিংসতা
কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। বিশ্লেষক বেভারলি ওচিয়েং জানান, এই অঞ্চলগুলোতে সরকারগুলো দ্রুত অর্থ সংগ্রহ করতে চায়, মূলত জিহাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য। মালিতে এই কাজ অনেকাংশে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ ও তাদের উত্তরসূরি “আফ্রিকা কর্পস”-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

মালিতে সামরিক বাজেট ২০১০ সালের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে এবং ২০২০ সাল নাগাদ তা জাতীয় বাজেটের ২২ শতাংশ দখল করে।

তবে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এই বাহিনীগুলো নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছে। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে বুরকিনা ফাসোর সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধেও।

ওয়াগনার বা আফ্রিকা কর্পস অনেক সময় সরাসরি সোনায় বা খনি সুবিধা হিসেবে তাদের পারিশ্রমিক পায় বলে জানা গেছে। কিন্তু এই বিপুল স্বর্ণসম্পদ সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায় না—বরং তা যাচ্ছে বিদেশি ভাড়াটে বাহিনী বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর পেছনে।

রক্তে রাঙা সোনা: নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
সাহেল অঞ্চলের সিংহভাগ সোনা আসে তথাকথিত “আনুষ্ঠানিক নয়” এমন খনি থেকে—যেখানে কোনও সরকারি নজরদারি নেই। এসব ছোটখাটো খনি বা ব্যক্তিগত খনন কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও জিহাদি গোষ্ঠী উভয়ের মধ্যেই সংঘর্ষ চলছে।

আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট জেএনআইএম (Jamaat Nusrat al-Islam wal-Muslimin) ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বুরকিনা ফাসোতে রেকর্ড সংখ্যক হামলা চালিয়েছে, যা তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংস্থা (UNODC)-র মতে, এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খনিগুলোর বেশিরভাগ সোনাই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে, যা বিশ্ব সোনা ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র।

রক্তের সোনা, কিন্তু কেউ পরীক্ষা করে না
যদিও “রক্ত হীরা” (blood diamonds) বন্ধে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যেমন ‘কিম্বারলি প্রক্রিয়া’ চালু হয়েছে, কিন্তু “রক্তসোনা” ঠেকাতে তেমন কোনও কার্যকর ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম কারণ হলো সোনার উৎস শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। সোনা প্রক্রিয়াজাত হয় খুব প্রাথমিক পর্যায়েই, যার ফলে তা কোথা থেকে এসেছে বোঝা যায় না।

চ্যাথাম হাউসের গবেষক ও জাতিসংঘের প্রাক্তন হীরা পর্যবেক্ষক ড. অ্যালেক্স ভাইনস বলেন,

“সোনা UAE-তে গলানো হয়, সেখান থেকে চলে যায় গহনা, চিকিৎসা, বা বিনিয়োগ শিল্পে। কিছু সোনা UK সহ বিভিন্ন পশ্চিমা বাজারেও পৌঁছায়—কিন্তু একবার গেলে, কোথা থেকে এসেছে তা জানার কোনও উপায় নেই।”

সোনার মূল্যবৃদ্ধি সাহেল অঞ্চলে স্বর্ণের চাহিদা যেমন বাড়াচ্ছে, তেমনি এই চাহিদার নিচে চাপা পড়ছে মানবাধিকার, নিরাপত্তা, ও অর্থনৈতিক সমতা। একদিকে সরকারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান—আর মাঝখানে রয়েছে হাজার হাজার সাধারণ খনি শ্রমিক, যারা দিনশেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাত্র ১৮ থেকে ৩৬ ডলার উপার্জন করেন।

বিশ্বের গহনার ঝলকে হয়তো এই সোনার দাগ দেখা যায় না। কিন্তু সাহেল অঞ্চলের মাটিতে তা রক্তের রেখা হয়ে থেকে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *