রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেনের হত্যার পরিকল্পনায় নাম উঠে এসেছে তারই ছাত্রী বর্ষার। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন ওই ছাত্রীর প্রেমিক মাহির। আরমানিটোলার নুরবক্স রোডের রৌশান ভিলার (১৫ নম্বর বাড়ি) তিনতলার সিঁড়ি থেকে জোবায়েদ হোসেনের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ভবনটির সিঁড়ি ঘরের নিচে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. মাহির রহমান (১৯), বার্জিস শাবনাম বর্ষা (১৯) ও ফারদীন আহম্মেদ আয়লান (২০)।
পুলিশ বলছে, মাহিরের ছুরিকাঘাতে আহত জোবায়েদ তার ছাত্রী ও প্রেমিকার কাছে শেষ মুহূর্তে বাঁচার আকুতি জানিয়ে সিঁড়িতে যখন ছটফট করছিলেন এই সময়ে জোবায়েদের উদ্দেশ্যে বর্ষা বলে, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হতে পারবো না’। এর কিছু সময় পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান জবি ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর জোবায়েদকে হত্যা পরিকল্পনা করে বর্ষা ও মাহির। মঙ্গলবার ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, মাহির রহমানের সঙ্গে বার্জিস শাবনাম বর্ষার দেড় বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ভুক্তভোগী জোবায়েদ হোসেন বার্জিস শাবনাম বর্ষাকে প্রায় এক বছর ধরে বাসায় গিয়ে পড়াতেন এবং একপর্যায়ে উভয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। ঘটনার একমাস আগে মাহির জানতে পারে জোবায়েদের সঙ্গে বর্ষার প্রেমের সম্পর্ক আছে।
বিষয়টি মাহির মেনে নিতে পারেনি এবং এর সূত্র ধরে মাহির ও বর্ষার মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয়। ঘটনার একপর্যায়ে বর্ষা মাহিরকে জোবায়েদকে হত্যা করার প্ররোচনা দেয় এবং তারা জোবায়েদকে হত্যা করার জন্য একাধিক পরিকল্পনা করে। জোবায়েদ বাসায় কখন পড়াতে আসেন এবং কখন চলে যান নিয়মিত বর্ষা মাহিরকে জানায়।
মাহির তার বন্ধু আয়লান এর সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি জানায় এবং তারা দু’জন আগানগর বৌবাজার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকা হতে ৫০০ টাকা দিয়ে একটি সুইচ গিয়ার চাকু কিনে। ঘটনার দিন রোববার ১৯শে অক্টোবর বিকাল অনুমানিক সাড়ে চারটায় জোবায়েদ বংশাল থানাধীন ৩১নং ওয়ার্ডস্থ নুরবক্স লেন এর ১৫নং হোল্ডিং রৌশান ভিলায় টিউশনি করাতে গিয়ে বাসার নিচতলার সিঁড়ির নিচে পূর্ব থেকে ওঁৎপেতে থাকা বর্ষার সাবেক প্রেমিক মাহির রহমান ও তার বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লান বাসার নিচে জোবায়েদ পৌঁছালে মাহির জোবায়েদকে বর্ষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে এবং একপর্যায়ে বাকবিতণ্ডা শুরু হলে মাহিরের ব্যাগে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু বের করে জোবায়েদের গলার ডান পাশে আঘাত করে। হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনার সময় বর্ষা তিন তলায় দাঁড়িয়ে ছিল।
এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বংশাল থানা সূত্রে আরও জানা যায়, ২০শে অক্টোবর রাত আনুমানিক সাড়ে আটটায় ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন ভাংনা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মাহির রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯শে অক্টোবর রাত আনুমানিক সাড়ে দশটায় নিজ বাসা থেকে বার্জিস শাবনাম বর্ষাকে গ্রেপ্তার করে বংশাল থানা পুলিশ। ২০শে অক্টোবর রাত আনুমানিক ১০টা ২০মিনিটে পল্টন থানাধীন চামেলীবাগ শান্তিনগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ফারদীন আহম্মেদ আয়লানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বর্ষা একই সময়ে তার প্রথম প্রেমিক ও জোবায়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিলো। ত্রিভূজ প্রেম থেকে বের হতে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা সাজায় ওই ছাত্রী। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর প্রথম প্রেমিক মাহির বিষয়টি নিয়ে ওই ছাত্রীকে চাপ প্রয়োগ করলে সেদিনই জোবায়েদকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে তারা। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘আমরা তদন্তে পেয়েছি মাহির ও তার প্রেমিকা একই বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকতো। মাহিরকে বর্ষা বলেছে- জোবায়েদকে না সরাতে পারলে আমি তোমার হতে পারবো না। মাহিরকে তার মা থানায় হস্তান্তরের বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, আসলে আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের নানা ধরনের কৌশল থাকে। আগে চট্টগ্রামের রাউজানে নিয়মিত শিক্ষার্থী অপহরণ করতো, মুক্তিপণ আদায় করতো। আমরা তখন অপহরণকারীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে তাদের ব্যবহার করে সমঝোতার চেষ্টা করতাম। ঠিক এভাবেই আমরা মাহিরকে থানায় দিয়ে যেতে চাপ প্রয়োগ করেছি। এটা আমাদের কৌশলের অংশ।
স্বেচ্ছায় থানায় হস্তান্তর করা হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যার বিষয়টি পুরো পরিকল্পিত। হত্যার পরিকল্পনা রাজনৈতিক কোনো বিষয় ছিল কিনা জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘মাহির ও তার প্রেমিকা গত ২৬শে সেপ্টেম্বর হত্যার পরিকল্পনা করে। এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই। এটা ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা।’
হত্যার মুহূর্তে জোবায়েদের প্রেমিকার শেষ কথার বিষয়ে লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, ‘বর্ষা আমাদের নিশ্চিত করেছে যে, জোবায়েদ মারা যাওয়ার সময়ে সে উপস্থিত ছিল। তদন্তে জানা গেছে, জোবায়েদের শেষ কথা ছিল বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে ‘আমাকে বাঁচাও’। বর্ষা তখন জোবায়েদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হবো না’। তদন্তে প্রকাশ পায় যে, দোতলার সিঁড়িতে জোবায়েদকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ সময় তিনি বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। ওই ছাত্রীর বাসা পাঁচতলায় হলেও ঘটনার সময় সে তিনতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিচের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে। জোবায়েদ দোতলার কলিংবেল বাজিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয় এবং দরজা থেকে রক্ত নিচে গড়িয়ে পড়ছিল।
কারাগারে ৩ আসামি: জোবায়েদ হোসেন হত্যার ঘটনায় তার ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা (১৯) সহ তিন জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া মাহিরের বন্ধু প্রীতম চন্দ্র দাস এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পৃথক চার আদালত তাদের জবানবন্দি ও সাক্ষগ্রহণ করেন। মেহেদী হাসানের আদালতে মাহির, মাসুম মিয়ার আদালতে বর্ষা ও জুয়েল রানার আদালতে আয়লান জবানবন্দি দেন। রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানান, আসামিরা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক মো. আশরাফ হোসেন জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন। আদালত পৃথক চার আদালতে ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি শেষে তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জোবায়েদ হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার সকালে বংশাল থানায় এ মামলা করেন জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত। এতে বর্ষাসহ তিনজনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৪-৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগ বলা হয়েছে, জোবায়েদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করতেন। প্রতিদিনের মতো তিনি রোববার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর হোল্ডিং রৌশান ভিলায় বর্ষাকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য যান। সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটের দিকে বর্ষা জোবায়েদ হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জানান যে, জোবায়েদ স্যার খুন হয়েছেন। কে বা কারা খুন করেছে। পরে জোবায়েদের ভাই রাত সাড়ে ৮টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান, রৌশান ভিলা ভবনের নিচতলা থেকে উপরে ওঠার সিঁড়ি ও দেয়ালে রক্তের দাগ দেখা যায়। ওই ভবনের তৃতীয় তলার পূর্বপাশে সিঁড়ির উপর জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উপুড় অবস্থায় দেখা যায়। সুরতহাল প্রস্তুত করার সময় তার গলার ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
জোবায়েদ জবির পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষা বর্ষের ছাত্র ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনার কৃষ্ণপুর গ্রামে। সোমবার জোবায়েদকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র ঘটনাস্থলে জড়ো হন তার সহপাঠী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। বিচারের দাবিতে তারা বিক্ষোভও করেন।
