আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সামরিক বাহিনীর যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, তার মধ্যে ১৫ জনকে হেফাজতে নিয়েছে সেনাসদর।
শনিবার ঢাকা সেনানিবাসের মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান।
তিনি জানান, তিন মামলায় ২৫ সেনা কর্মকর্তাকে আসামি করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জন অবসরে। একজন এলপিআরে। বাকি ১৫ জন সেনাবাহিনীতে কর্মরত।
মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরে কর্মরত ১৫ জন এবং এলপিআরে থাকা ১ জনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনা সদরে জয়েন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনাসদরে আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ছাড়া বাকি ১৫ জন রেসপন্স করেছেন। তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তারা ফ্যামিলি থেকে ডিটাচ (বিচ্ছিন্ন) আছেন। এই সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ গত ৯ তারিখে বাসা থেকে বের হন। এরপর থেকে আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি সেনা সদরে জয়েনও করেননি।
তিনি বলেন, গত ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম দুটি চার্জশিট জমা পড়ে। এরপর তৃতীয় আরেকটা চার্জশিট জমা পড়ে। এই সংবাদ আসা শুরু করে বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে। আমরা টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, চার্জশিট জমা পড়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল এক্সেপ্টেড হয়েছে। চার্জশিটগুলোর মধ্যে একটা ছিল গুম সংক্রান্ত, যারা তখন ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিল তাদের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ। আরেকটা ছিল র্যাবের টিএফআই নিয়ে। অপর একটি ছিল ৪-৫ আগস্টের রামপুরার ঘটনা নিয়ে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর আইজিপির কাছে চলে যায়। নিয়ম অনুযায়ী এবং ২২ তারিখ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয় (গ্রেপ্তার করে হাজির করার জন্য)। তবে আমরা (সেনাবাহিনী) এখন পর্যন্ত কোনো চার্জশিট কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি। চার্জশিটে প্রায় ২৫ সেনা কর্মকর্তার নাম এসেছে। এর মধ্যে অবসরে আছেন ৯ কর্মকর্তা, এলপিআরে আছেন ১ কর্মকর্তা এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন কর্মকর্তা। যারা অবসরে চলে গেছেন তাদের প্রতি আমাদের সেনা আইন ওইভাবে খাটে না।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ তারিখ কর্মরত ১৫ ও এলপিআরে থাকা এক সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে আসার জন্য একটা আদেশ সংযুক্তি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আদেশে তাদের বলা হয়েছে, ৯ তারিখে তারা যেন ঢাকা সেনানিবাসে সেনা হেফাজতে চলে আসেন। আমরা কিন্তু এখনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি বা পুলিশও আমাদের কিছু জানায়নি। তারপরও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে স্বপ্রণোদিত হয়ে এ কর্মকর্তাদের হেফাজতে আসার জন্য আদেশ দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই ধরনের প্র্যাকটিস করে। সংবেদনশীল কেসে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, শুরুতে তাদের আমরা হেফাজতে নিয়ে থাকি। পরে প্রয়োজন মতো কোর্ট-মার্শাল বা অন্যান্য আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমরা যাদের হেফাজতে আসার জন্য বলেছি, তাদের অধিকাংশই সাড়া দিয়েছেন; তবে একজন সাড়া দেননি। ওই কর্মকর্তা ৯ তারিখ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া জানাননি।
১০ অক্টোবর আমরা তার সঙ্গে ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। জানতে পারি তিনি ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে বের হয়েছিলেন, কিন্তু পরে বাড়ি ফেরেননি এবং পরিবারের সঙ্গে তার মোবাইলফোনেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। তিনি মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ।
তিনি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিয়ম অনুযায়ী তাকে ‘ইল্লিগ্যাল অ্যাবসেন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করি। এছাড়া ১০ অক্টোবর আমরা এ বিষয়ে আরও কিছু আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। একই সঙ্গে ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে তিনি অবৈধভাবে দেশের বাইরে যেন যেতে না পারেন- এর ব্যবস্থা করা হোক।
আমরা তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়ও লোক পাঠিয়েছি। তিনি দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন- এই আশঙ্কা মাথায় রেখে কাঠামোগতভাবে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। আমি নিজে ডিজি-ডিজিএফআই, ডিজি- এনএসআই এবং ডিজি-বিজিবির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি।
হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হবে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাদের পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও চায় গুম, খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঠিক বিচার হোক। সেনাবাহিনী চায় ইনসাফ। ন্যায়বিচার বা ইনসাফের প্রশ্নে সেনাবাহিনী আপোসহীন।
মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান বলেন, ওয়ারেন্ট ইস্যুর বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ২২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে তাদের হাজির করার বিষয়ে আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালনকালে অভিযুক্তরা কোনো অন্যায় করেননি; তবে বিভিন্ন বাহিনীতে প্রেষণে গিয়ে কিছু ব্যক্তি অপরাধে জড়ান বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বুধবার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় ১৭ জন এবং জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের মামলায় ১৩ জন আসামি।
তাদের মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। পরোয়ানা জারির দিনই তা সংশ্লিষ্ট ১৩টি দপ্তরে পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর কর্মকর্তারা। আগামী ২১ অক্টোবরের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করে ২২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।