নতুন পে স্কেলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য যেসব সুবিধা থাকছে

নতুন পে স্কেলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য যেসব সুবিধা থাকছে

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন জাতীয় বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি মেয়াদেই এটি গেজেট আকারে প্রকাশ এবং ২০২৬ সালের শুরু থেকেই বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, নতুন কাঠামোয় শুধু মূল বেতন বাড়ানো নয় চিকিৎসা, শিক্ষা ও পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ভাতায় আসছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এরই মধ্যে জাতীয় পে কমিশন গঠিত হয়েছে, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারের কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেবে।

সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত পে কমিশনকে একটি টেকসই, ন্যায়সঙ্গত ও যুগোপযোগী বেতন কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে। ডিসেম্বর থেকে বাজেট সংশোধন শুরু হলে সেখানে নতুন কাঠামো কার্যকরের বিধান যুক্ত করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল থেকেই সরকারি কর্মচারীরা নতুন কাঠামোর সুবিধা পাবেন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বেতন-ভাতা সংস্কার ও কাঠামো আধুনিকায়নের ওপর জোর দিচ্ছে। সরকার মনে করছে, নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়িত হলে সরকারি চাকরিজীবীদের আর্থিক নিরাপত্তা বাড়বে, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা ও উদ্দীপনাও বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১০:১। নতুন কাঠামোতেও এটি ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার প্রস্তাব রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অনুরূপ অনুপাত প্রচলিত।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, এবার শুধু মূল বেতন নয় ভাতা, প্রণোদনা ও অবসর সুবিধায়ও বড় পরিবর্তন আনা হবে।

নতুন কাঠামোয় যেসব বড় পরিবর্তন আসছে
১. বেতন বৃদ্ধি:

নতুন পে-স্কেলের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেতন বৃদ্ধি পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য থাকবে বিশেষ প্রণোদনা ভাতা, যাতে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হন।

২. চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি:

বর্তমানে মাসে ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান কর্মচারীরা। নতুন কাঠামোয় এই ভাতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হবে এবং অবসরোত্তর সময়েও চিকিৎসা সুবিধা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

৩. শিক্ষা ভাতা বৃদ্ধি:

সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় বহনে সহায়তার জন্য শিক্ষা ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ থাকবে। এতে সরকারি কর্মচারীদের পরিবারের শিক্ষাব্যয় কমবে।

৪. ন্যায়সঙ্গত অনুপাত:

১:৮ বা ১:১০ অনুপাত কার্যকর করে বেতন কাঠামোয় বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

৫. সুসংগঠিত কাঠামো:

নতুন পে-স্কেল হবে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট, যাতে কর্মীরা সহজেই বুঝতে পারেন কোন পদে কত সুবিধা পাবেন।

টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডে ভিন্নমত

সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনঃপ্রবর্তনের দাবি তুলেছে। তাদের মতে, অনেক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই পদে থাকলেও পদোন্নতি না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

তবে পে কমিশনের ভেতরে আরেকটি মত রয়েছে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল রেখে পদোন্নতির প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা উচিত। কারণ একই সঙ্গে দুই ধরনের সুবিধা রাখলে কাঠামো জটিল হয়ে যায়।

২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে গঠিত কমিশন ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। কমিশন জানায়, ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়া হবে।

কর্মচারীর পরিবারের ছয়জন সদস্য ধরে ব্যয় হিসাব করে নতুন বেতন কাঠামোর রূপরেখা নির্ধারণ করা হচ্ছে। ১ অক্টোবর থেকে কমিশনের ওয়েবসাইটে ( paycommission2025.gov.bd) কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে, যা ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদেই গেজেট আকারে নতুন পে-স্কেল প্রকাশ করা হবে।”

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখা হবে, যাতে ২০২৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে নতুন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যায়।

নিম্নগ্রেডের কর্মচারীরা মনে করেন, বর্তমান বাজারদরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ১০:১ অনুপাত অন্যায্য বৈষম্য তৈরি করছে। তারা চান, সর্বনিম্ন বেতন ১৬-২০ হাজার টাকা বেসিক ধরা হোক।

অন্যদিকে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মনে করেন, অনুপাত ১০:১ বহাল না রাখলে উচ্চ গ্রেডের বেতন তুলনামূলকভাবে কমে যাবে, এতে সরকারি চাকরিতে মেধাবীরা নিরুৎসাহিত হবেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “শুধু বেতন বাড়ালেই হবে না, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অবসর-পরবর্তী সুবিধাও বাড়াতে হবে।”
তাদের মতে, এতে সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনমান উন্নত হলেও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ১০ শতাংশ বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য ৮৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের বছরের ৮২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার চেয়ে বেশি।

অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে, নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা ও জীবনমান উভয়ই উন্নত হবে, যা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে আরও কার্যকর করে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *